বৃষভ কেন শিবের বাহন?
বৈদিক রুদ্র ও পৌরাণিক
শিবে নেই কোণও বিশেষ পার্থক্য – যিনি রুদ্র, তিনিই শিব, যিনি শিব, তিনিই রুদ্র।
ঋগ্বেদে রুদ্রকে বলা হয়েছে ‘বৃষভ’, পুরানে ‘বৃষভ’ শিবের বাহন। সাধারনতঃ বলীবর্দকে
আমরা বলি বৃষভ। শিবের সৌম্য এবং রুদ্র – দুই ভাবের প্রকাশই বৃষভে বিদ্যমান।
ক্রুদ্ধাবস্থায় বৃষভ বীর্যবান, দুর্ধর্ষ, ভীষণসংহারমূর্তি, কিন্তু স্বাভাবিক
অবস্থায় সে শান্ত, নিরীহ, অনুগত, লোকহিতকারী,
কৃষি ও পরিবহনাদি কাজে গৃহস্থের নিত্য সহায়ক ও নানা অভীষ্টবর্ষী। এ কারনেই বৃষভ
হয়েছে শিবের বাহন।
‘বৃষভ’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ
– বলবান এবং শুক্রল। কৃষি, পরিবহনাদি কাজের দ্বারা বৃষভ যেমন গৃহস্থের নানা
প্রয়োজন সিদ্ধ করে , তেমনি প্রজননের প্রয়োজনে একটি বৃষভকে বহু গাভীর কামনা পূরণে
সমর্থ দেখা যায়। বৃষভ কামবর্ষী। আশুতোষ শিবও নিত্য বরদ, তিনি ভক্তগনের কামনা বা অভীষ্ট
পূরণে সর্বদা উন্মুখ। ভক্তের বিধানে তিনিও কামবর্ষী বা অভীষ্টবর্ষী। এ বিচারেও
শিবের সার্থক বাহন হয়েছে বৃষভ। শিব বা রুদ্রের বলবত্তার ভাবটিও বৃষভে বিদ্যমান।
বৃষভস্কন্ধ উন্নত স্বাস্থ্যের লক্ষণ। বীর্যবাণ পুরুষগণের স্কন্ধপেশী বৃষভের ককুদের
ন্যায় পীবর দেখা যায় না কি? ‘বৃষভ’ শব্দটি অন্য শব্দের পশ্চাতে ব্যবহৃত হলে ‘শ্রেষ্ঠ’
শব্দ জ্ঞাপন করে। দেবাদিদেব শঙ্কর সকল দেবতারও দেবতা, সংহর্তারুপে অসীম শক্তিধর ও
বীর্যবান, তিনি পীবরস্কন্ধ, পুরুষর্ষভ, দেবতার মধ্যে দৈবতর্ষভ। শক্তিমান দেবতা
শক্তিমান বাহনই গ্রহন করেছেন।
বৃষভ শিবের বাহনরূপে
পরিগণিত হল কবে এবং কিরুপে? এ বিষয়ে মহাভারতে এই উপাখ্যান আছে। উপাখ্যানটি
সংক্ষেপে এইঃ প্রজাসমুহ উৎপন্ন হল। কিন্তু তাদের জীবিকার উপায় কি? উৎপন্ন প্রজাগন
প্রজাপতি দক্ষের শরনাপন্ন। দক্ষ প্রজাপতি মনুষ্যগনের জীবিকার কথা স্মরণ করেই স্বয়ং
অগে অমৃত পানপূর্বক তৃপ্তিজনক উদ্গার ত্যাগ করেন। অমৃতপানে তৃপ্ত দক্ষ প্রজাপতির এ
উদ্গার থেকে জন্ম হয় গোমাতা সুরভীর। সুরভীর গর্ভে কপিলা গাভীদিগের জন্ম। কপিলা
গাভীর দুগ্ধই নির্ধারিত হয় প্রজাগণের জীবিকার তথা পরিপুষ্টির উপায়রুপে।
এক দিনের কথা। কপিলাগণ
মাতৃস্তন্য পান করে ফেন উদ্গীরন করেছে। সেই ফেন দৈবক্রমে শিবের মস্তকোপরি পতিত।
শিব এতে অত্যন্ত বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হন এবং রুষ্ট নয়নে নিরীক্ষণ করেন কপিলাগণকে। শিবের
ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে কপিলাগনের বর্ণ নানা প্রকার হতে থাকে। শিবকে কুপিত দেখে দক্ষ
গোমহিমা কীর্তন প্রসঙ্গে বলেন – ‘তোমার ক্রুদ্ধ হওয়া উচিত হয় নি। কপিলাগণ অতি
পবিত্র। তাদের মুখভ্রস্ট ফেন উচ্ছিষ্টরূপে পরিগণিত হয় না। দেখ, এরা দুগ্ধ ও ঘৃত
দ্বারা সংসার প্রতিপালন করছে। সুতরাং তুমি ক্রোধ সংবরন কর।’ ক্ষেপাকে সন্তুষ্ট
করার জন্য দক্ষ কতকগুলো গাভিসহ একটি বৃষভও তাকে দান করেন। শিব মহাপরিতুস্ট।
বৃষভবরকে তিনি করেন নিজের বাহন ও ধ্বজ। ঋগ্বেদে যিনি ছিলেন শুধু বৃষভ, মহাভারত ও
পুরানে এরুপেই তিনি হন বৃষভবাহন এবং বৃষভধ্বজ।
এতদ্বিষয়ক বৃহদ্ধর্ম্ম
পুরানের উপাখ্যানটি অন্যপ্রকার। কথিত হয় – সতীর জন্য দক্ষ এক স্বয়ম্বর সভার আয়োজন
করেন। কিনতি সতী মনে মনে মহেশ্বরকেই পতিরূপে বরন করে ফেলেছেন। স্বয়ম্বর সভায়
মহেশ্বরকে উপস্থিত না দেখে সতী ‘নমঃ শিবায়’ মন্ত্র উচ্চারনপূর্বক বরমালা ভুমিতে
অর্পণ করেন এবং প্রার্থনা জানান যেন দেবাদিদেব স্বয়ং সে মালা গ্রহন করেন। সতীর
প্রার্থনায় সত্য সত্যই শিব ভুমি ভেদপূর্বক উত্থিত হয়ে বরমাল্য গ্রহনপূর্বক
তৎক্ষণাৎ অন্তর্হিত।
কিছুকাল পরে শিব পুনরায়
দক্ষালয়ে। উদ্দেশ্য – সতীদর্শন। কিন্তু তিন এসেছেন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের বেশে। এসে
পার্বতীর রত্নমুখী নাম্নী এক সখীকে ছলনা করে বলেন – ‘তাই তো, শিব বরমাল্য নিলে,
কিন্তু বিয়ে করে গেল না। যদি আপত্তি না থাকে তবে আমিই দাক্ষায়নীর পাণিগ্রহণ করতে
পারি।’ শুনেই তো রত্নমুখী হয় কৃষ্ণমুখী। ভীষণ চটে গিয়ে বলে – ‘দূর হও এখান থেকে।’
কিন্তু নীলকুন্তলা বলে বলে – ‘না লো, অমন করিস নে, আমার মনে হয় স্বয়ং সদাশিবই
এসেছেন সতীকে গ্রহন করতে।’ প্রগলভা রত্নমুখীর মুখরতা আরও বেড়ে যায়। বলে – ‘তোর
যেমন বৃষের মতো বুদ্ধি এবং শিবভক্তি, তাতে তোর বৃষ হওয়াই উচিত ছিল।’ নীলকুন্তলা
খুশি। বলে – ‘ তা হলে তো বেশ হবে। অনুক্ষণ শিবসন্নিধানে বসবাস করতে পারব।’ বলতে
বলতে নীলকুন্তলা ধারন করেন বৃষরুপ এবং শিবও স্বমূর্তিতে তার স্কন্ধে আরোহণ করে তার
মনোবাসনা পূর্ণ করেন।
বলে রাখা ভাল – এ
গল্পটি বৃষভ বাহনের আদি কথা নয়। এ ঘটনা যখন ঘটেছিল, তখনো নন্দী বাহনরূপে শিবের
নিত্য সেবক। অভীষ্টবর্ষী শিব কিভাবে ভক্তের কামনা পূর্ণ করেন নীলকুন্তলার কাহিনী
তারই অন্যতম দৃষ্টান্ত। শিবভক্ত মাত্রই বাঞ্ছা করেন, নন্দীর ন্যায় সৌভাগ্য অর্জনে।
শিববাহন নন্দী যেমন সর্বদাই প্রভুর পদসেবা করে ধন্য, কৃতার্থ, তেমনি ভক্তমাত্রেই
চাহেন কিঙ্করবৃত্তি অবলম্বনপূর্বক শিবসালোক্য ও শিবসামীপ্য লাভ। ভক্তিমতী
নীলকুন্তলা ভুল করেননি কিছু। রত্নমুখীর কৃষ্ণমুখ দেখেও তিনি শিবভক্তিতে ছিলেন
অচলা। সংশয়, সন্দেহ ও অবিশ্বাসে দোলায়িত হয়নি তার চিত্ত। ফলে, তিনি অমর হয়ে রইলেন
শিবের নিত্য দাসরূপে।
------------- স্বামী নির্মলানন্দ
(বইঃ মূর্তি পুজা কি ও কেন?)
Like us on: www.facebook.com/Alokito.Manush.Knowledge
<<<<<<<<>>>>>>>>
No comments:
Post a Comment