Thursday, July 18, 2013

গণেশের পূজার অগ্রাধিকারের রহস্য


গণেশের পূজার অগ্রাধিকারের রহস্যঃ

               সকল দেবতার অগ্রে গনেশের পূজা বিহিত। কিন্তু কেন? জাতীয় জীবনের বিভিন্ন স্তরের উন্নতি ও কল্যানের ক্ষেত্রে এর সার্থকতা কোথায়?
                হিন্দু বহুদেবতার উপাসক। লক্ষ্মী, সরস্বতী, বিশ্বকর্মা, বিষ্ণু, শিব, শীতলা, মনসা, দুর্গা, মঙ্গলচণ্ডী, ষষ্ঠী, কার্তিকেয় আদি নানা দেবতার পুজারাধনা হিন্দুর ঘরে ঘরে প্রচলিত। উচ্চকোটি নিষ্কাম সাধকগণের কথা বলছি না। কিন্তু সাধারন জনতা সকাম। তারা এ সকল দেব দেবীর আবাহন, অর্চনা, স্তবন, বন্দনা করেন সাধারনতঃ কোনও না কোনও কামনার বশবর্তী হয়ে সে কামনা ব্যষ্টিগত বা সমষ্টিগত উভয়বিধই হতে পারে। লক্ষ্মীর উপাসনায় ধন, সরস্বতীর উপাসনায় বিদ্যা, বিশ্বকর্মার উপাসনায় শিল্প, কার্তিকেয়র উপাসনায় সুপ্রজা ও বিজয়, শীতলার উপাসনায় নিরাময় এরুপ ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনের নানা প্রয়োজনের প্রেরনায় মানুষ নানা  দেবতার আরাধনায় ব্রতী হয়। বিচার করলে দেখা যাবে এ সব দেব দেবীর উপাসনার অর্থ হচ্ছে তা হতে ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনের এক একটি বিশেষ বিশেষ সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিত লাভ করা। সেই ইঙ্গিত কোথায় লভ্য? এক কথায় উত্তর গনেশের পূজায়।
                   গনেশ গণশক্তি বা সমষ্টিশক্তির প্রতীক। এই গনশক্তির জাগরন, সংহতিকরন ও সম্মিলিত সম্যক নিয়োজন ব্যতীত সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় জীবনের কোন সমস্যার সমাধানই সম্ভব নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকেই হোক, শিল্পনৈতিক দিক থেকেই হোক, অথবা কৃষি, বিজ্ঞান, শিক্ষা, সেচ, স্বাস্থ্য যে কোন দিক থেকেই হোক, সংহতি ব্যতীত কোন ক্ষেত্রেই কোন জাতি অভ্যুদয় লাভ করতে পারে না। আগে গনশক্তিকে জাগাও, সুসংগঠিত কর, দেখবে তোমার সকল আরম্ভ সুফলপ্রসু হতে চলেছে। আগে গনেশের পূজাটি ঠিক ঠিক সম্পাদিত হলে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিকেয়, ষষ্ঠী, শীতলা, হরিহর সকলের পুজাই সার্থক। সকলের শক্তি যেখানে ঐক্যবদ্ধ, সেখানে পর্বতপ্রমাণ বিঘ্নও নিমিষে অপসারিত, কঠিনতম কাজও হয়েছে বিঘ্নেশ, এ জন্যই তাকে বলা হয় সিদ্ধিদাতা এবং তার পূজাটিও নির্দিষ্ট হয়েছে সকল দেবতার পূজার অগ্রে।
                                                      
                                                                                                                               --- স্বামী নির্মলানন্দ


( Collected by Yudhistir Rudra)


<<<<<<<>>>>>>>> 



Friday, July 12, 2013

নটরাজ শিব



নটরাজ শিবঃ

           সতীশোকাতুর শিবের তাণ্ডব নৃত্যের কথা আমরা সবাই জানি। শোকের বিহবল অভিব্যাক্তিকে এমন উদ্দন্ড নৃত্য তিন নেচেছিলেন, যাতে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল সমগ্র বিশ্বজগৎ। তদীয় নৃত্যের রুদ্রতাল প্রলয়ে প্রকাশ। কিন্তু এর একটি শান্ত ছন্দও আছে, যা জীবের চিত্ত বিনোদন করে। নৃত্য তদীয় স্বভাব, নাদময় সঙ্গীত তদীয় স্বরূপ। ডমরুর ডিডিম ডিডিম তালে, কণ্ঠবাদ্যের ববম ববম ধ্বনিতে বেজে ওঠে প্রনবাত্মিক মোহন ব্রহ্মসঙ্গীত, আর সেই সঙ্গীতের ছন্দে ছন্দে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই জেগে ওঠে নৃত্যকলার অপরুপ চারু চরণবিভঙ্গমা। নৃত্য, গীত, বাদ্য এ তিন তৌর্যের সহযোগে হয় নাটক। কথিত হয় এ নাট্যশাস্ত্রের আদি প্রবক্তা শিব। তিনি প্রথমে ব্রহ্মাকে এ পঞ্চমবেদ নাট্যবেদ উপদেশ করেছিলেন। ব্রহ্মা ভরতকে বলেন এবং ভরত তা মর্ত্যে প্রচার করেন। ভরতমুনির নাট্যসূত্র প্রাচীন ভারতের শ্রেষ্ঠ নাট্যশাস্ত্র।
                     স্কন্দপুরানে নটরাজ শিবের চারি মাসব্যাপী এক নৃত্যাভিনয়ের কথা উল্লেখিত। আষাঢ় মাসের চতুর্দশী তিথিতে আরম্ভ হয়ে কার্ত্তিক মাসের শুক্লা চতুর্দশী পর্যন্ত ঐ নৃত্য অবিরাম চলেছিল। সেই নৃত্যবাসরে উপস্থিত ছিলেন সকল দেবগণই। ঋষিগণ, সিদ্ধগণ, যক্ষগণ, পিশাচগণ, গুহ্যকগন,সাদ্য ও বসুগণও দর্শকের গ্যালারী পূর্ণ করেছিলেন।ছয় রাগ এবং ছত্রিশ রাগিনীর উপস্থিতির কথাও আছে। ঐ নৃত্যকালে মৃদঙ্গ বাজিয়েছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা, তাল দিয়েছিলেন কেশব, বংশী বাদকরূপে ছিলেন ইন্দ্র; অগ্নি, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, চন্দ্র, সূর্য প্রভৃতি দেবতাও নিস্ক্রিয় ছিলেন না। পাগলাকে নাচাবার জন্য কেউ পনব, কেউ উপাঙ্গ, কেউ ঘণ্টা, কেউ বা শূর্প বাদ্যও বাজিয়েছিলেন। এ সব বাদ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গন্ধর্বগনের কোকিলকণ্ঠবিনিঃসৃত মধুর সঙ্গীত। বেশ সেজেগুজেই নৃত্য করেছিলেন শঙ্কর। সর্পগণ হয়েছিল তার মুকুটভূষণ, সর্বাঙ্গে লেপন করেছিলেন তিনি শুভ্রজ্জ্বল ভস্মরাগ, পরিধান করেছিলেন নানাবিধ ভূষণ। নৃত্যের আসরটি বেশ জমজমাট হয়েছিল, তাতে সন্দেহ কি?
                   কেবল নৃত্যে নহে, সঙ্গীতেও শিব সর্বলোকশ্রেষ্ঠ। তদীয় কণ্ঠসঙ্গীত শ্রবণে  স্বয়ং লোকপাল বিষ্ণুও পাদপর্যন্ত বিগলিত হয়েছিলেন। সে বিগলিত বিষ্ণুপাদসত্তা ব্রহ্মা স্বীয় কমণ্ডলুতে ধারন করেন। এই দ্রবীভূত বিষ্ণুপাদই গঙ্গানদী নামে খ্যাতা।

                                                                      ------ স্বামী নির্মলানন্দ

(Collected by Yudhistir Rudra)


<<<<<>>>>>>

Tuesday, July 9, 2013

তর্পণ কেন করা হয়?



তর্পণ কেন করা হয়?

           আত্মা যে অমর, তার বড় প্রমাণ হল এই মহালয়া। পিতা-মাতা বা আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর পর শ্মশানে পুড়িয়ে দিলেই সব মিটে গেল, এ ধারণাটা একেবারেই ঠিক নয়। মহালয়া হল পুরোপুরি বিজ্ঞানসম্মত। সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর সব ক্ষেত্রেই মহালয়ার তর্পণ বাধ্যতামূলক হয়ে এসেছে। স্মরণাতীত কাল থেকেই আমরা এটা পালন হয়ে আসতে দেখেছি। এতে কোনও জাতিভেদ নেই। প্রথমত, মহালয়ার দিনে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়। অর্থাৎ এর মধ্যে দিয়ে আমাদের উদারতাই প্রকাশ পায়। একজন মানুষ কতখানি কর্তব্যপরায়ণ, তারও বড় প্রমাণ এই মহালয়া।
           এবার একটু ব্যাখ্যায় যাওয়া যাক। মৃত্যুর পর পিতৃপুরুষরা বাস করেন প্রেতলোকে। বছরের একটি সময়ই তারা মর্ত্যে আসেন কিছু পাওয়ার আশায়। জীবিতকালে তারা সন্তান সন্ততির জন্য যা কিছু রেখে যান, তা ভোগ করার সুযোগ তাদের হয় না। কিন্তু তারা আশা করেন, বছরের একটি দিন অন্তত সন্তান সন্ততির সেবা পাবেন। তারা যে অতীতকে ভুলে যায়নি, তাও উপলব্ধি করতে পারবেন। প্রেতলোক থেকে মর্ত্যলোকে এসে পিতৃপুরুষরা থাকেন কালীপূজো পর্যন্ত। এর মধ্যে সর্বসম্মতভাবে মহালয়ার দিনটিকেই তর্পণের দিন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। ঐ দিন পিতৃপুরুষকে জলদান করাটাই  শাস্ত্রসম্মত, এমনকি বিজ্ঞানসম্মতও। সাধারন নিয়মে কেবল জলদান করলেই চলে। তবে যার সামর্থ্য আছে, সে চন্দন এবং তিল দিতে পারে। কেউ কেউ ভোজ্যও দিয়ে থাকে। যেমন, চাল, ডাল, কলা ইত্যাদি।
           ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধশেষে তর্পণ করেছিলেন। শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে যাওয়ার পথেও করেছিলেন তর্পণ। গঙ্গা হল পবিত্র। তাই সকলে চেষ্টা করেন গঙ্গায় গিয়ে তর্পণ করতে। তবে নিয়ম অনুযায়ী, বাড়িতেও তর্পণ করা যায়। অনেকে তো প্রত্যেকদিনই তর্পণ করে থাকে। এটা পিতৃপুরুষের প্রতি সম্মান, ভালবাসার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। আর, সেই ভালবাসা না পেলে পিতৃপুরুষ রীতিমত রুষ্ট হন। তারা যেমন সন্তানসন্ততির কাছ থেকে জল পেলে শান্তি পান, তৃপ্তি বোধ করেন, ঠিক তেমনই জল না পেলে অভিসম্পাত করতে করতে ফের প্রেতলোকে ফিরে যান। জলদান করা মানে যে কেবল আত্মশুদ্ধি তাও নয়। এর মাধ্যমে পৃথিবীর সকলকে সেবাও করা যায়।
                                                              ------- মুরারীমোহন বেদান্তাদিতীর্থ শাস্ত্রী
(Collected by Yudhistir Rudra)

<<<<< >>>>>     

Thursday, July 4, 2013

বিষ্ণুর বাহন কেন গরুড়?



বিষ্ণুর বাহন কেন গরুড়?

         গরুড় নামধেয় কোনও পক্ষিবিশেষ বর্তমানে আমাদের স্থুল দৃষ্টির বিষয়ীভূত নয়। সুতরাং, জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিতে কোন আলোচনা ও যুক্তি প্রদর্শন এক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কিন্তু তথাপি গরুড় সম্বন্ধে কিছু না বলে আমরা ক্ষান্ত হতে পারি না। কারণ, এই মহাত্মার চরিত্রকথা অতি উপাদেয় ও লোকশিক্ষামূলক।
             বেদে বিষ্ণুকে বলা হয়েছে সুপর্ণ এবং গরুত্মান। পুরাণকারেরা  এদুটি শব্দ উপজীব্য করেই সম্ভবতঃ বিষ্ণুর বাহনরূপে নির্দিষ্ট করেছেন প্রাগুক্ত পক্ষিবরকে। বেদোক্ত তার্ক্ষ্য পক্ষীর সঙ্গেও বিষ্ণুবাহন গরুড়ের বলবীর্য ও চেষ্টার আশ্চর্য সাদৃশ্য আছে। তার্ক্ষ্য বা শ্যেন বা সুপর্ণ স্বর্গ থেকে সোম আনয়ন করেছিল। তখন ঘোরতর যুদ্ধ হয়।  তার্ক্ষ্য- শত্রু-পরাভবকারী, কিন্তু স্বয়ং অপরাজেয়। জননী বিনতাকে দাস্যবৃত্তি থেকে সমুদ্ধারের জন্য পুরাণোক্ত গরুড় পক্ষীও স্বর্গ থেকে অমৃত আনয়ন করেছিলেন। তৎকালে ইন্দ্রাদি দেবতার সঙ্গে তার তুমুল যুদ্ধ হয়। দেবগন তার সঙ্গে বিজয়ী হতে পারেন না। নিরুপায় ইন্দ্র অবশেষে নিক্ষেপ করেন বজ্র-তদীয় প্রসিদ্ধ অব্যর্থ অস্ত্র। উত্তরে শুধু হাস্য করেন মহাবল গরুড়। পরে বজ্রেরই সম্মান রক্ষার জন্য বিসর্জন করেন নিজে একটি মাত্র পর্ণ বা পালক।
            শক্তি ও ভক্তি-উভয়ের সমন্বয়ে গরুড়চরিত্র। তার মত মাতৃভক্ত জগতে সুদুর্লভ। নির্লোভতার দিক থেকেও তার চরিত্র অনুপম। নিজ ভুজবিক্রমে হস্তগত হয়েছে অমৃতভাণ্ড, তত্রাচ অমৃতে নেই তার বিন্দু মাত্র লোভ বা আসক্তি। গরুড়ের এই লোকোত্তর চরিত্র বিশ্বপালক বিষ্ণুকে পর্যন্ত আকৃষ্ট করে। তিনি প্রসন্ন হয়ে বলেন- বর গ্রহন কর। গরুড় চাইলেন অমৃত পান ব্যতীতই অমর হতে এবং সর্বদা বিষ্ণুর উপরে থাকতে। বিষ্ণু স্বীকার করেন ভক্তের এই প্রার্থনা। নিজ অভীষ্ট পূর্ণ হলে গরুড়ও আহবান করেন বিষ্ণুকে অভিলষিত বর গ্রহণে। বিষ্ণু বলেন- তবে তুমি আমার বাহন হও। গরুড় উত্তরে বলেন তথাস্তু। বরদান ছলে ভগবান ভক্তকে স্থান দেন নিজেরও উপরে স্বীয় দিব্য রথের সর্বোচ্চ ধ্বজ্জায়, স্বয়ং খ্যাত হন গরুড়ধ্বজ নামে এবং একই প্রণালীতে ভক্তও বিকিয়ে দেন নিজেকে ভগবানের রক্তরাঙ্গা শ্রীচরণকমলে তার নিত্যদাস রূপে। ভক্ত ও ভগবানের পরস্পরের এই বরদান - লীলা আজও আমাদের অন্তরে গভীর পুলক সঞ্চার করে। গরুড়ের ভক্ত্যুজ্জ্বল আদর্শ অনুসরন পূর্বক আমাদেরও অকুণ্ঠ কণ্ঠে প্রার্থনা করতে ইচ্ছা হয় - 
             যথা ত্বং সংপুটকরঃ সততং নতস্কন্ধরঃ।
             তথৈব পুরতো বিষ্ণো স্ত্বৎপ্রসাদাদ ভবাম্যহম।
                          হে ভক্তবর গরুড়! তুমি যেমন সর্বদা ভগবান বিষ্ণুর সমীপে যুক্তকর ও নতশির, তোমার প্রসাদে আমরাও যেন ঠিক তেমনটি হতে পারি।
-          স্বামী নির্মলানন্দ

( Collected by Yudhistir Rudra )