কালকে গ্রাস করেন যিনি, তিনিই কালীঃ
কালকে গ্রাস করেন যিনি,
তিনিই কালী। তাই ‘কালীতন্ত্রে’ উল্লেখ করা হয়েছে ‘কলনাৎ সর্বভুতানাং’, সব
স্থাবর-জঙ্গমকে তিনি গ্রাস করেন। কিন্তু যিনি গ্রাস করেন তাকে পুজা করে হয় কেন?
কেনই বা তার পায়ে আনত হওয়া? মুণ্ডমালা বিভূষিতা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, ঘোরা, এই
দেবী আমাদের বাংলা সাধন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন। কথায় বলে যেখানেই
বাঙালি সেখানেই মা কালী। শুরু করা যাক একটা কাহিনী দিয়ে। বাংলার লোককাহিনী ছরিয়ে
আছে বাংলার আকাশে-বাতাসে। দেবী কেন শিবকে পায়ের তলায় ফেলে রেখেছেন? কাহিনীটি এরকম,
একবার মহাঘোরা দেবী ধ্বংসের উন্মাদনায় মাতলেন, এই বিশ্বকে শ্মশানে পরিনত করতে করতে
এগিয়ে যেতে থাকলেন দেবী, তার পথ রুদ্ধ করবে এমন সাধ্য কার! দেবকুল চিন্তিত হয়ে
পড়লেন, এভাবে দেবী ধ্বংস করতে থাকলে সমস্ত বিশ্বে সৃষ্টি বলে কিছু অবশিষ্ট থাকবে
না। কিন্তু কে রক্ষা করবে সৃষ্টি? একমাত্র মহাদেবই এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে
সক্ষম। দেবকুল তারই শরনাপন্ন হলেন। শান্ত মহাদেবের ওষ্ঠের প্রান্তে ফুটে ওঠে মৃদু
হাসির চিহ্ন। তিনি চললেন কালী সন্নিধানে। ধ্বংসলীলার তাণ্ডব করতে করতে এগিয়ে
চলেছেন দেবী, হঠাৎ তার পা কার যেন অঙ্গ স্পর্শ করল! স্তব্ধ হল দেবীর পথ চলা।
তাকিয়ে দেখলেন কিসের উপর পদবিস্তার করলেন তিনি। দেখামাত্রই স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
স্বয়ং শিব তার পদতলে শুয়ে আছেন। স্বামীর গায়ে পাদস্পর্শ করেছেন তিনি, লজ্জায় জিব
কাটলেন কালী, ধ্বংসলীলাও স্তব্ধ হল! এ কাহিনী নিছকই লৌকিক কাহিনী। তবু শিবের শব
হয়ে মায়ের পায়ে পড়ে থাকাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন সাধকেরা। সাধক রামপ্রসাদ
লিখেছেনঃ শিব নয় মায়ের পদতলে।/ ওটা মিথ্যা লোকে বলে!!/ দৈত্য বেটা ভূমে পড়ে,/ মা
দাঁড়ায়ে তার উপরে,/ মায়ের পাদস্পর্শে দানবদেহ/ শিবরূপ হয় রনস্থলে!!
সাধকের দৃষ্টিতে
দৈত্য মায়ের স্পর্শে হয়েছেন শিব। অসুরশক্তি শান্ত সমাহিত হয়েছে, দেবী এই রুপান্তরে
তুষ্টা। পরিতৃপ্ত! রামপ্রসাদের এই রচনায় আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষিত হয়, সেটি হল –
‘রণস্থল’। দেবী-কাহিনী ও রূপবর্ণনায় বারংবার একটি যুদ্ধের পরিবেশ টেনে আনা হয়েছে।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রীশ্রীচণ্ডীতে দেবীর আগমন ও উৎপত্তি এই যুদ্ধকে
কেন্দ্র করেই। সুর আর অসুরের যুদ্ধে দেবী অসুর নিধনে তৎপরা। একটির পর একটি রূপ
পরিবর্তন করে দক্ষকন্যা সতী হয়েছেন হিমালয়দুহিতা পার্বতী। পার্বতী দেবী দুর্গা বা
মহিসাসুরমর্দিনীরূপে মহিষাসুরকে বধ করেছেন, তারপর দেবতাদের আহবানে শুম্ভ-নিশুম্ভ
বধের জন্য নিজ দেহ থেকে সৃষ্টি করেছেন কৌশিকী দেবীর। দেবী কৌশিকীর ভ্রুকুট কুটিল
ললাট ফলক থেকে নির্গত হয়েছেন পাশহস্তা কালী। দেবী ভয়ংকরী ‘হং’ এই মহাশব্দে চারিদিক
নিনাদিত করে অসুর নিধনে তৎপরা! অর্থাৎ পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দেবী পার্বতীই
বিভিন্ন স্তরে বিবর্তিত হয়ে দেবী কালিকায় পর্যবসিত হয়েছেন! একই শক্তির ভিন্ন
প্রকাশ ছাড়া এরা আর কিছুই নয়!
যে কোন
দেবীর উৎপত্তির ইতিহাস খুজতে আমরা বৈদিক সাহিত্যের আশ্রয় গ্রহন করি। বেদে দেবী
কালী অগ্নিশিখার অন্যতম একটি শিখা! মুন্ডক উপনিষদে যজ্ঞাগ্নি-বর্ণনায় যজ্ঞাগ্নির
সাতটি জিহ্বার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কালী করালী চ মনোজবা চ/ সুলোহিতা যা চ
সুধুম্রবর্ণা।/স্ফুলিঙ্গিনী বিশ্বরুচি চ দেবী/ লোলায়মানা ইতি সপ্ত জিহ্বা!!
এখানে কালী
আহুতি গ্রহণকারী অগ্নিজিহ্বা মাত্র। দেবী কালিকার সঙ্গে কৃষ্ণবর্ণ, ঘোর অন্ধকার
রাত্রির একটি অনুষঙ্গ সর্বদাই জড়িয়ে থাকে। দেবী সর্বদাই ভয়ংকরী! দেবীর সঙ্গে
অন্ধকারের এই মেলামেশা অনেক পণ্ডিতকে বেদের প্রসিদ্ধ ‘রাত্রি সুক্ত’ দেবী ধারনার
উৎপত্তিক্ষণ বলে মনে করিয়ে দেয়। শুক্ল যজুর্বেদে সমস্ত লোক আঁধারে ভরিয়ে দেয়, এমন
শক্তিকে রাত্রি দেবী রূপে বন্দনা করা হয়েছে। অথর্ববেদে বিভিন্ন অমাবস্যার রাত্রি
বিভিন্ন নামে চিহ্নিত হতে দেখি। যেমন, দৃষ্টচন্দ্রা অমাবস্যার নাম ‘সিনীবালী’,
নষ্টচন্দ্রা অমাবস্যার নাম ‘কুহু’। দেবী পুরানে দেবীর স্তবে বলা হয়েছে, ‘সিনীবালী
কুহুশ্চৈব রাকা চানুমতী তথা’ (১২৭/১৮৩) এখানে অমাবস্যার বিভিন্ন নাম দেবীরুপেই বন্দিত
হয়েছে। চণ্ডীর মধ্যে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘কালরাত্রির্মহারাত্রি-র্মোহরাত্রিশ্চ
দারুণা।’ এই কালরাত্রিকেই বহু পণ্ডিত দেবী কালীর উৎপত্তিস্থল বলে চিহ্নিত করেছেন।
শশিভূষণ দাশগুপ্ত তার
বিখ্যাত ‘ভারতের শক্তি সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’ গ্রন্থে বিভিন্ন বাংলা সাহিত্যে
দেবী কালিকার উপস্থিতি নির্দেশ করেছেন। তার মতে, মহাকবি কালিদাসের সময়ে হয়ত দেবী
কালিকার ধারনা পুষ্ট ছিল না, কিন্তু ‘কালিদাস’ নামটিতেই যে দেবীর উপস্থিতি রয়েছে।
‘কালিদাস’ নামটির অর্থ কি ‘কালীর দাস’? যদি তাই হয় তবে, শশিভূষণ দাসগুপ্তের মতে,
কালিদাসের সময় অল্প হলেও দেবী কালিকা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। তার ‘কুমারসম্ভব’
রচনায় দেখি, দেবী কালী উপমারূপে ব্যবহৃত। কুমারসম্ভবে বলা হচ্ছে, মহাদেব চলেছেন
বিবাহ করতে। বরযাত্রীদের মধ্যে যে মাতৃকাদের বর্ণনা আছে তাতে সকলের পিছনে
‘কপালাভরণা’ কালী ঠিক যেন গণ নীলমেঘের মধ্যে বলাকাগুচ্ছের মতো শোভা ধারন করেছেন। অর্থাৎ,
কালিদাসের যুগে দেবী কালিকা অপ্রধান দেবীদের একজন ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনিই
প্রধানা হয়ে উঠেছেন।
কালীপূজা আর
দুর্গাপূজা, দুইই বাংলার জীবনে আনন্দের উৎসব। কিন্তু দুর্গাপূজা বলতে আমরা এক
ব্যাপকতাকে বুঝি, এই পুজায় জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র যেন সমানভাবে অংশগ্রহন করে। এ
কেবল যিনি পুজা করছেন তার পুজা নয়, এতে পারিপার্শ্বিক সমস্ত শ্রেণী উপস্থিত। এই
ব্যাপকতা বছরে একবারের জন্য। কিন্তু দেবীরূপে কালী যেন ব্যাক্তিগত সাধনার অঙ্গ। কালীসাধক
রূপে বাংলার বহু ব্যক্তিত্বই উল্লেখযোগ্য স্থান গ্রহন করেছেন, উনবিংশ শতাব্দীর
নবজাগরণের অগ্রদুত রাজা রামমোহন থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ পর্যন্ত। পাঠক চমকে গেলেন নাকি?
ব্রাম্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা রামমোহন রায় কালীর সাধক! রাজা রামমোহন রায়ের
সাধন-ইতিহাস বলে তন্ত্রসাধক রূপে তিনি কালী উপাসনা করেছিলেন বৈকি! কিন্তু
ব্রাহ্মসমাজের বিবর্তনের ধারা একটু ভিন্ন পথে নিয়ে গিয়েছে।
বেদ পুরাণ
মহাকাব্যের আঙিনা পেরিয়ে আমরা আজ বর্তমান যুগে যে দেবীকে কালীরূপে পুজা করছি, সেই
দেবী পুরাণে বর্ণিত দেবীর মতো ভয়ংকরী নন, আমরা তার মাতৃরুপ দিতে গিয়ে উগ্রতা
অনেকটা কমিয়ে এনেছি, দেবী হয়েছেন শ্যামাকালী, রক্ষাকালী, দক্ষিণাকালী।
এই সব রূপে দেবী ভক্তের
মনোবাঞ্ছা পূরণে সর্বদাই তৎপরা।
-------
পূর্বা সেনগুপ্ত (মূর্তিপুজা কি ও কেন)
Like us on: www.facebook.com/alokito.manush.knowledge
<<<<<<<<>>>>>>>>
No comments:
Post a Comment